ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে,আমার নামটি লিখো_ তোমার মনের মন্দিরে...আমার পরানে যে গান বাজিছে তাহার তালটি লিখ...... এত টুকুতেই এলার্ম টা বন্ধ করে দিল তন্ময়। ঘড়ির কাঁটা তখন ৮ টা ছুঁয়ে গেছে। মোবাইল স্ক্রীনে আজকের তারিখ টা তার চোখে একটু বেশী স্পষ্ঠ মনে হচ্ছে। আজ থেকে ঠিক এক বছর আগে,এই দিনটি তে নাহিনের মাঝে নিজেকে হারিয়ে এসেছিল সে।আর আজ ঠিক এক বছর পর নিজেকে ফিরে চাইবে নাহিনের কাছে। ভাবতেই সেই দিনটা তন্ময় এর চোখে ভেসে উঠল। দিনটি ফেব্রুয়ারির ১৪ তারিখ থাকায় তন্ময় এর সব বন্ধুরা খুব ব্যস্ত ছিল ভালোবাসা দিবস কে কিভাবে কাজে লাগাবে। কেউ এই সুযোগে পুরানো প্রেম কে নতুন করে ঝালিয়ে নেয়ার পরিকল্পনা,কেউ নতুন করে প্রেমে পরা,কেউ নিজের ভালোবাসার মানুষের মনের কাছাকাছি যাওয়ার প্রচেষ্টায় খুবই হুলস্থূল একটা পরিস্থিতি বানিয়ে রেখেছিল সকাল থেকে। তন্ময় এসবে খুব মজা পেয়েছিল সেদিন, বন্ধুদের নিয়ে অনেক হাসাহাসি করেছিল। তন্ময়ের মতে আমরা যাদের ভালোবাসি তাদের আমরা প্রতিটি দিনই ভালোবেসে যেতে পারলে,তবেই তা ভালোবাসা। এই একটি দিন নিয়ে এত মাতামাতি করার মানেই ছিলনা তার কাছে। সেই ১৪ই ফেব্রুয়ারি তন্ময় বন্ধুদের সাথেই ছিল। তখন মাত্র তাদের অনার্স ফাইনাল শেষ হয়েছিল,তাই সব বন্ধুরা নিজ নিজ গন্তব্যের দিকে ছড়িয়ে পরার আগে গত চার বছরের স্মৃতিচারণ এবং আসন্ন দিনগুলিতে মনের মধ্যে লালন করার সুন্দর কিছু মুহূর্ত জোগাড় করতে ছাত্রাবাসে থেকে গিয়েছিল।
অনেক কথা কাটাকাটি,হাসাহাসি, আর দ্বিধা দন্দের পরে সব বন্ধুরা ক্যম্পাসের কাছেই এক প্রোগ্রামে গিয়ে হাজির হয়েছিল। ভালোবাসা দিবসের এই প্রোগ্রামে বন্ধুরা আগে থেকেই তাদের বান্ধবীদের আসতে বলেছিল। তন্ময় সেখানে গিয়ে প্রতিবারের মতই অবাক হচ্ছিল,এত তরুণ-তরুণী সেখানে জমা হয়েছিল নিজেদের ভালোবাসা নানাভাবে প্রকাশ করতে। পৃথিবীকে নিষ্ঠুর বলার মানে কি;যখন এর মাঝে এত মানুষের মনেই ভালোবাসার উপস্থিতি। এই ভাবনা তে ডুব দিয়ে এর গভীরে যাওয়ার আগেই কেউ একজনের ধাক্কায় তন্ময় ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে এল।
স্যরি,এক্সট্রিম্লী স্যরি ভাইয়া,বলেই লালা জামা পরা মেয়েটি খিলখিল শব্দে হেসে উঠল।মেয়েটি কে এভাবে হাসতে দেখে তন্ময় বিস্মিত চোখে শুধু তাকাল,কিছু বলতে পারলনা। মেয়েটি অনেক কষ্টে হাসি চাপিয়ে আবারও স্যরি বলে সেখান থেকে কেটে পরল। তখনই পেছন থেকে একটা আওয়াজ তন্ময়ের কানে পৌঁছাল_ “এই তুই এভাবে হাসলি কেন,কি ভাববে ছেলেটা!”। এটা যে অন্য মেয়ের স্বর,তা বুঝতে অসুবিধা হলনা তন্ময়ের। তখনি আগের স্বরের মেয়েটি বলে উঠল, “তা দিয়ে আমি কি করব,ভীরের মধ্যেও সে একার মত দাঁড়িয়ে আছে,স্যরি শুনে এমন ভাবে তাকিয়ে ছিল যেন আকাশ থেকে এখনি নেমে এসেছে,তার এমন চেহারা দেখে আমি না হেসে পারিনি,হাঃ হাঃ তার তুই কি বুঝবি,তুই তো তার সেই চাহারাটাই দেখসনি...” কথা বলেই যাচ্ছিল সেই লাল জামা পরা মেয়েটি,কিন্তু নাহিনের কানে তার বান্ধবী রিক্তার এসব কথার কিছুই পৌঁছায় নি। “একা” শব্দটি তার কানে গেঁথে যাওয়ার পর বাকী শব্দগুলো শুনার জন্যে নাহিনের মন সেখানে ছিলনা।তার মন কোথায় জানি হারিয়ে ছিল তখন। তন্ময় পিছনে ফিরে দেখল রিক্তা নাহিনের মুখের সামনে নিজের হাত টা নাড়িয়ে বলছিল, “তুই কি আমার কথা শুনছিস! এই নাহিন,কি ভাবতেছিস এখন আবার?”। তন্ময় বুঝল সেই অন্য স্বর টি তাহলে নাহিন নামের মেয়েটির, এর আগে মেয়েটি তার চোখেই পরেনি; যখন ধাক্কা দিয়ে ওই মেয়েটি স্যরি বলেছিল,এই মেয়েটিও পাশে ছিল। হাল্কা বেগুনী আর সাদা জামায় মেয়েটি কে দেখতে কেমন জানি লেগেছিল তন্ময়ের কাছে,মনে হচ্ছিল এই মেয়ে এখানকার কেউ না,অনেক দূর থেকে আসা কেউ। “উহু,রিক্তা আমি তোর কথাই শুনছিলাম” নাহিন এটা যখন বলতেছিল,তখনও তন্ময় ওদের দুজনের দিকে তাকিয়েছিল। সেদিনের ঘটনার পর তন্ময় মেয়ে দুটির নাম জানার পাশাপাশি এটাও জেনেছিল,এই নাহিন মেয়েটি আর সব মেয়ে,অন্তত রিক্তার থেকেও অনেক আলাদা। সে সবার মত প্রাণবন্ত ছিলনা, এই প্রোগ্রামে এসেও এর সব কিছুতেই অনুপস্থিত ছিল মেয়েটি। প্রতিটি মুহূর্ত অন্য কোথাও হারিয়ে ছিল,আর এই হারিয়ে থাকা মানুষটি কে খুঁজতেই যেন পুরো প্রোগ্রাম এর সময় টা তন্ময়ের দৃষ্টি মেয়েটির উপর ছিল। নাহিন না খেয়াল করলেও, রিক্তা এবং নাহিনের বেশ কিছু বন্ধু খেয়াল করেছে তন্ময়ের এই উৎসুক দৃষ্টি।
এরপর থেকে তন্ময় এর চিন্তা চেতনায় শুধু নাহিন ছিল। বন্ধুদের থেকে খোঁজ নিয়ে জেনেছিল নাহিনের বাসা কোথায়,সে কিসে পড়ে। তার তীব্র জানার ইচ্ছা তাকে বাস্তব জগতে না হলেও ভাবনার জগতে নাহিনের কাছাকাছি পৌঁছে দিয়েছিল। একটা মেয়ের নীরবতা আর একাকী সে শান্ত চেহারার মায়াতে পরে তন্ময় তাকে ভালোবাসতে শুরু করল। নাহিন কে দেখতে কত অজুহাতে যে তার কলেজ এলাকায় গেছে তার হিসেব মনে হয় তন্ময়ের নিজেরও মনে নেই। লুকিয়ে এক নজর নাহিন দেখলেই মনের অস্থিরতা কেটে যেত। একদিন হঠাৎ রিক্তার সাথে দেখা হয়ে গিয়েছিল কলেজ গেইটে। রিক্তা তন্ময় কে ভালোভাবেই চিনত, এবং এখানে আসার পেছনের কারণটাও জানত। সে তন্ময় কে একসাথে চা খেতে বলেছিল। রিক্তা নাহিনের ছোটবেলার বান্ধবী,ওর থেকে নাহিন সম্পর্কে জানা যাবে_ এই ভেবে তন্ময় সুযোগ টা নিয়ে নিল।
কিভাবে শুরু করবে তা তন্ময় বুঝতে পারছিলনা, রিক্তাই বলে উঠল “ ভাইয়া আপনি নাহিন কে দেখতে প্রায় আসেন এখানে,তাইনা? সেই যে প্রোগ্রামটায় দেখা,এরপর থেকে এই কয়েক মাসে আমি আপনাকে অনেক বার দেখেছি এখানে”। তন্ময় ঠিক কি বলবে বুঝতে পারছিলনা,শুধু মাথা নারল।আর তার মনে হল এইভাবে নাহিন কি ভেবেছে কখনো! “রিক্তা,আমার এখানে আসা নিয়ে নাহিন কি কিছু বলেছে? ও কি কারণটা বুঝতে পারে?” তন্ময়ের কথা শেষ না হতেই রিক্তা হেসে বলল “পাগলীটা যদি বুঝত!সে তো এটাই খেয়াল করেনি আপনি কে”। কথাটা শুনে তন্ময়ের মনটা কেমন ভার হয়ে এসেছিল। রিক্তা ব্যপারটা বুঝতে পেরে তন্ময় কে সেদিন সব বলে দিয়েছিল। নাহিন আপনাকে দেখেনি এতে আপনি মন খারাপ করে কি হবে। সে নিজে যে একজন জীবিত মানুষ, এটা সে নিজে কবে খেয়াল করেছিল কে জানে। নাহিন ছোট বেলা থেকে খুব ছটপটে একটা মেয়ে ছিল। অনেক দুষ্ট ছিল,নাহিন একাই এত কথা বলত আমরা আর কেউ সুযোগ পেতাম না কথা বলার। আমরা সবাই শুধু ওর কথাই শুনে যেতাম, ও সবার খুব প্রিয় ছিল। এখন নাহিন যেমন চুপ,তখন ঠিক উল্টো টা ছিল। ওর মনটা খুব নরম,অনেক আবেগী একটা মেয়ে,তার হাসির শব্দে সব কিছু হেসে উঠত আবার কারো কষ্টে সে মিষ্টি মেয়েটি কেঁদে দিত মুহূর্তেই। যখন নাহিন কলেজে ভর্তি হয়েছিল তখন ও সে খুব প্রাণচঞ্চল ছিল। নাহিন একটা ছেলেকে তখন খুব পছন্দ করত। ওর হাসিখুশি জীবনে তখন খুশির জোয়ার এসেছিল। কিন্তু হঠাৎ ওর আব্বু রোড এক্সিডেন্টে মারা গেলেন,এরপর নাহিনের হাসি আমরা আর দেখিনি। নাহিন তার বাবা-মা এর একমাত্র মেয়ে ছিল। আঙ্কেল এর মৃত্যুতে আন্টি এত ভেঙ্গে পরেছিলেন যে তিনি নাহিন কে আর স্বান্তনা দিয়ে সামলে নিতে পারেন নি। বাবার শুণ্যতা আর ঘরে মায়ের করুণ চেহারা,এসব নাহিন কে ভেতর থেকে ভেঙ্গে দিয়েছিল। সারাদিন সে রুমে বন্দী করে রাখত নিজেকে,আমরা গেলেও তেমন কথা বলতনা। যে মুহূর্তে নাহিনের খুব ভালোবাসার দরকার ছিল,একজন কাছের সঙ্গীর দরকার ছিল, তখনই সেই ছেলেটা ও নাহিন কে একা করে চলে গেল যে কিনা নাহিনের বাবার মৃত্যুর কিছুদিন আগেই আমাদের সবার সামনে নাহিন কে বলেছিল সে সারাজীবন নাহিনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু আর কাছের মানুষ হয়ে থাকতে চায়। এরপর থেকে নাহিন একাই রয়ে গেছে। সেদিন তার সব কথা নাহিন বিশ্বাস করেছিল,অনেক খুশি ছিল। কিন্তু ওর এভাবে চলে যাওয়া নাহিন কে কষ্টের মাঝে এতটাই পাথর করে দিয়েছিল যে আমাদের সবার মাঝে থেকেও নাহিন প্রাণহীন ছিল তখন থেকে,আজও নাহিন তেমন রয়ে গেছে। সে হাসিখুশি নাহিন যেন কোথায় হারিয়ে গেছে,কথাগুলো বলতে বলতে রিক্তার চোখ থেকে জল বেয়ে পরছিল। আর নাহিনের কষ্ট নিজের মধ্যে অনুভব করে তন্ময়ের বুকে যে মোচড় দিচ্ছিল তা লুকোতেই সে আর দেরী না করে সেদিন রিক্তা থেকে বিদায় নিয়েছিল নিজের ফোন নাম্বার টা দিয়ে।
সেদিনের পর থেকে তন্ময় ফোনে রিক্তার কাছে খোঁজ নিত নাহিনের। রিক্তা নাহিন কে বলেছিল তন্ময়ের কথা। নাহিন কোন সাড়া দেয়নি, একবার ও কিছু জানতে চায়নি কেন অথবা কি। এসবে তন্ময় কখনো ব্যথা পায়নি,কারণ এটাই স্বাভাবিক ছিল নাহিনের ক্ষেত্রে। তন্ময়ের মনে হত সে যেন অনন্ত কাল থেকে চিনে নাহিন কে। নাহিনের এসবে তন্ময়ের এতটা স্থিরতা দেখে রিক্তা মাঝে মাঝে খুবই অবাক হত,সে ও বুঝেছিল যে এখানে ভালোবাসা কতটা গভীর। ঠিক এমন ভালোবাসাই পারে নাহিন কে জাগিয়ে তুলতে,যে কিনা বেঁচে থেকে ও মৃত। নাহিনের জন্মদিনে কলেজ বন্ধুরা যখন পার্টি দিয়েছিল,সেখানে তন্ময় কে ডেকেছিল রিক্তা। সেদিনই ২য় বার সামনা সামনি দেখা তন্ময় আর নাহিনের। হৈ হুল্লোড়ে ব্যস্ত সবার মাঝে নাহিন সেদিন ঠিকই খেয়াল করেছিল তন্ময়ের নীরবতা,যে কিনা প্রতিক্ষণে নাহিনকেই দেখছিল। সবার অগোচরে তন্ময়ের চোখ আর মনের ভাষা বুঝে নিয়েছিল,এটা তন্ময় নিজেও টের পায়নি। যে মানুষ নিজের জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ভালোবাসার অভাব অনুভব করছে,সে ভালোবাসাকে এত কাছে থেকেও চিনবেনা তা কি করে হয়। যে ভালোবাসা নাহিন কে নীরব করে রেখে গেছে,আজ সেই ভালোবাসাই কিছুক্ষণের জন্যে তার নীরবতা ভেঙ্গে দিয়েছে। সেদিন নাহিন তার অতীতে ফিরে গিয়েছিল,সবার অজান্তে। পরে পার্টি শেষে সবাই বিদায় নেয়ার সময়ই নাহিন তার ভাবনার জগত থেকে বেরিয়ে আসে। পার্টি থেকে তন্ময় রিক্তার সাথেই বেরিয়েছিল রাস্তায়,আর তখনই ঠিক হয়েছিল এই ১৪ই ফেব্রুয়ারি নাহিন কে মনের কথা জানাবে তন্ময়। তন্ময় তখন রিক্তার থেকে জানতে চেয়েছিল নাহিন কে কখন কিভাবে ভালোবাসার কথা জানানো যায়। রিক্তা বলেছিল “ আর কিছুদিন পরই তো ভালোবাসা দিবস,তুমি নাহিনকে তো গতবছর সে দিনটাই দেখেছিলা,সুতরাং এই ১৪ তারিখ বলতে পার”। সেদিন মনে আশা নিয়ে ঘরে ফিরেছিল তন্ময়,আর কয়েকটা দিন পরই নাহিন কে ভালোবাসি বলতে পারবে সে,যেটা কিনা প্রতিটা মুহূর্তে সে আপন মনে বলে,আবার ভয় ও হচ্ছিল নাহিন কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে তা ভেবে। এখনও ভাবছে তন্ময়,ফেলে আসা এই একটি বছরের কথা। ভাবতে ভাবতেই বাইরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। এবার আয়না তে নিজেকে দেখছে সে,কোথাও কোন ত্রুটি আছে কিনা সেটা খেয়াল করতেছে। সুন্দর একটা খয়েরী পাঞ্জাবী গায়ে,চুল ও পরিপাটি করে নিল যত্ন করে। এত সুন্দর করে নিজেকে তৈরি করা শুধু ভালোবাসার মানুষটির জন্যে। মানুষ যখন কাউকে ভালোবাসে তখন তার সব কিছু ঐ একটা মানুষকে ঘিরেই যেন ঘুরতে থাকে,তার চোখে নিজেকে সবচেয়ে সুন্দর আর সবচেয়ে ভাল প্রমাণ করতেই যেন সকল ব্যস্ততা। কিন্তু অবুঝ মন এটা ভুলে যায় যে ,সে যেমনই হোক না কেন তার ভালোবাসার মানুষটিও শুধু তাকেই সেরার আসনে রাখে। তন্ময় ও এর ব্যতিক্রম করেনি,হঠাৎ আয়নায় দেয়ালের উল্টো দিকে টাঙ্গানো ঘড়িতে তার দৃষ্টি পরতেই সে বুঝল সময় কত গড়িয়েছে। তখন ১০টা বাজে,সে রিক্তা কে বলেছিল ১১টায় থাকতে। রিক্তা নাহিন কে নিয়ে ঐ প্রোগ্রামেই আসবে ঠিক সেই জায়গায়, যেখান থেকে তন্ময়ের জীবনে ভালোবাসার অধ্যায়ের সূচনা। তন্ময়ের বাসা থেকে যেতে বেশি হলে ৩০মিনিট লাগবে। পথে যেতে ফুল নিবে সে নাহিনের জন্যে,এসব প্ল্যান আগে থেকেই করা। তাই সে দেরী না করে বেরিয়ে পরল। বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মাকে বলে গেল “মা দোয়া কর,আজ এসে যেন তোমায় ভাল খবর দিতে পারি” । ছেলের এই কথা শুনে মা অবাক হলেও কিছু বলার সময় পেলেন না,ততক্ষণে তন্ময় দোতলা থেকে নেমে গেছে।মা গেইট খোলার শব্দ পেলেন। পেছন থেকে শুধু ছেলের জন্যে দোয়া করে দিলেন। তন্ময় তার বাসার গলি পার হয়ে রাস্তার ওপাশের ফুলের দোকানে যেতেই দেখল বাহারি ফুলের সম্ভার। আজকের দিন উপলক্ষ্যে অন্য দিনের চেয়ে দোকানটায় অনেক বেশি আর বাহারি ফুল রাখা। নাহিনের জন্যে কোন ফুলের তোড়া নয়,লাল গোলাপই নিবে সে,তবে শুধু দুটি। এখন থেকে নাহিনের জীবনে সে আর একা নয়,ওরা দুজন _তার প্রতীক এই দুটি গোলাপ; নাহিনের সাথে পরিচয়ের আজ ২য় বছর শুরু হবে তার প্রতীক। তন্ময় জানেনা নাহিন এসবের কিছু বুঝবে কিনা,কিন্তু তার কাছে আজ এসব ছোট ব্যপার গুলো অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ফুল গুলি কেউ বুঝবেনা মত করে নিয়ে তন্ময় একটা রিকশায় উঠল। উঠেই যে ঘড়িতে চোখ রাখল,তা আর অন্য কোথাও নড়লনা।আজ যেন পথটা অনেক লম্বা,কিছুতেই শেষ হওয়ার নাম নেই। ভালোবাসা অপেক্ষার চেয়ে দীর্ঘ কিছু হয়না। আর এর থেকে মধুর ও কিছু নেই, তবে সেটা বুঝা যায় শুধুমাত্র যখন অপেক্ষা শেষে ভালোবাসার বৃষ্টি হয়। রিকশাওয়ালা মামার ডাকে তন্ময় রিকশা থেকে নামল। ভাড়াটা দিয়েই সে রীতিমত দৌড়াল সেই জায়গাটার দিকে। দূর থেকেই সে রিক্তা কে দেখল,চিনতে অসুবিধা হলনা।আজ ও লাল রঙের জামাতে,তার পাশের মেয়েটি ও লাল জামা পরা। তবে কি নাহিন আজ লাল পরেছে! এই এক বছরে নাহিনের সাথে যতবার দেখা হয়েছে প্রতিবারই হালকা রঙের পোশাক ছিল,মনে হত উজ্জ্বল রঙের সাথে তার যেন আড়ি।
কাছে যেতেই রিক্তা তন্ময় কে হাই দিল।তন্ময় দেখল লাল জামা পরা পাশের মেয়েটা নাহিন নয়। সে প্রশ্ন করার আগেই রিক্তা বলে উঠল, “নাহিন এসেছে,কি একটা কাজে ঐ দিকটায় গেছে”।তখনই পেছন থেকে শুনা গেল, “তন্ময় তুমি এসেছ”। সেই পরিচিত কন্ঠ,মূহুর্তেই যেন হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেল তন্ময়ের। পেছনে ফিরতে অনেক সাহস আর শক্তির প্রয়োজন মনে হল। যখন পেছনে ফিরল সে দেখল আজ একটা আকাশী রঙের জামা গায়ে নাহিন,মনে হচ্ছে আকাশ থেকে নামা কোন পরী। ভীরুমনে কোন ভূমিকা ছাড়াই তন্ময় বলল, “নাহিন,তোমায় কিছু কথা বলতেই এখানে আসা”। কত কথা সাজিয়ে এসেছিল সে,সবই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে।এত মাস ধরে যা বলতে চেয়েছে সবই যেন হারিয়ে গেছে। কি বলবে কিছুই বুঝতে পারছেনা সে। নাহিন তখন ও শান্ত,স্থির চোখে তাকিয়ে আছে তন্ময়ের দিকে।এই চাহনি তন্ময়কে আরও বেশি ভুলিয়ে দিচ্ছে সব। “নাহিন,নিজেকে আর একা করে রেখোনা।তুমি যেখানেই যাবে,আমাকে পাবে। তোমাকে আমি ভালোবাসি, আমার মৃত্যু পর্যন্ত তুমি আর একা হবেনা”। কিছু না ভেবে টানা কথা গুলো বলে ফেলল তন্ময়। এরপর আর নাহিনের দিকে তাকানোর সাহস হলনা,নিচের দিকে তাকিয়ে রইল। ঐ একটি মুহূর্তে তার মনে হচ্ছিল নাহিনের জবাবের উপরই তার বাকি জীবন নির্ভর করছে। তখনই নাহিন তন্ময়ের হাত দুটি দু’হাত এ ধরল,আর তার টলমলে চোখ থেকে এক ফোঁটা জল তন্ময়ের হাতে পরল। কিছুই বলতে হলনা নাহিন কে,এই এক মুহূর্তে যেন না বলা সব কথা বুঝে নিল তন্ময়। লুকিয়ে রাখা ফুল গুলো বের করে দিতেই নাহিন এর ঠোঁট এক চিলতে চাঁদের মত দেখাল। চোখে জল,আর মৃদু হাসি মাখা মুখে নাহিন কে এত মায়াবী মনে হল,এই রুপ দেখতেই যেন তন্ময় তার এত গুলো ফাগুন অপেক্ষা করেছিল। একে অপরের চোখে তাকিয়ে যেন ভুলেই গেল আশেপাশে আর কেউ আছে, তারা ততক্ষণে নিজেদের মাঝেই হারিয়ে গেছে। এই অনুভূতি শুধু তারাই বুঝতে পারে যাদের জীবনে সত্যিকারের ভালোবাসা এসেছে। ভালোবাসায় তীব্র যন্ত্রণা থাকে,তবু ভালোবাসায় যে সুখ পাওয়া যায় তা আর কোথাও নেই। ভালোবাসার অনুভূতি শুধু ভালোবাসায় নিহিত।